
আমরা অনেকেই ‘হেপাটাইটিস’ শব্দটির নাম শুনলে আতঙ্কিত হয়ে উঠি। আসলে এটা ভয় কিংবা আতঙ্কের কিছু নেই। আপনি সচেতন হয়ে উঠুন, স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে পারবেন।
গত সোমবার (২৮ জুলাই) ছিল বিশ্ব হেপাটাইটিস দিবস। এ নিয়ে দেশ-বিদেশে অনেক সচেতনামূলক সেমিনার হয়েছে। জানার চেষ্টা করুন, হেপাটাইটিস কি আসলেই নীরব ঘাতক? যদি এমন মনে হয়, তাহলে সচেতন হোন আপনি এবং আপনার পরিবার। আপনার সন্তানের টিকা নিন, পরীক্ষা করুন এবং স্বাস্থ্য নিয়ে সচেতন হোন। হেপাটাইটিস সম্পর্কে বিস্তারিত জানার চেষ্টা করুন।
হেপাটাইটিস কী সেটি ভালোভাবে জেনে নিই। কারণ হেপাটাইটিস হচ্ছে— লিভার সংক্রমণ বা প্রদাহ। একটি ভাইরাস, অ্যালকোহল, ওষুধ কিংবা অটোইমিউন রোগের কারণে হতে পারে। ভাইরাসজনিত হেপাটাইটিস সবচেয়ে বেশি দেখা যায়, যার প্রধান পাঁচটি ধরন হচ্ছে— হেপাটাইটিস এ, বি, সি, ডি ও ই।
এটি ঠিক আমাদের শরীর, বিশেষ করে লিভার বা যকৃৎ– এর ওপরে কী প্রভাব ফেলে, তা পরিষ্কার নয়। এটি এমন একটি মারাত্মক স্বাস্থ্যসমস্যা, যা সঠিক সময়ে ধরা না পড়লে ধীরে ধীরে লিভার নষ্ট করে দিতে পারে।
এসবের মধ্যে সবচেয়ে বিপজ্জনক হলো— হেপাটাইটিস বি ও সি। কারণ এগুলো বহু বছর শরীরে থেকে যায় এবং ধীরে ধীরে লিভারকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে থাকে। তবে উদ্বেগের বিষয় হলো— সংক্রমণের একদম শুরুর দিকে এর কোনো লক্ষণ শরীরে দেখা নাও দিতে পারে। সাধারণত লিভারের সমস্যার প্রকট লক্ষণ দেখা দেয়, সমস্যা অনেক বেশি বেড়ে গেলে। তাই মৃদু লক্ষণেই সাবধান হওয়া খুব জরুরি।
দীর্ঘমেয়াদে হেপাটাইটিস বি বা সি হলে শুধু সিরোসিসই নয়, লিভার ক্যানসার হওয়ার সম্ভাবনাও বেড়ে যায়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্যমতে, বিশ্বে প্রতি বছর লিভার ক্যানসারে যে লাখ লাখ মানুষ মারা যায়, তাদের বড় একটি অংশই আগে হেপাটাইটিসে আক্রান্ত ছিলেন।
যে উপসর্গের মাধ্যমে হেপাটাইটিস নীরবে লিভার নষ্ট করে দিতে পারে—এর মধ্যে হচ্ছে, ঘন ঘন ক্লান্ত লাগা, ক্ষুধামন্দা, ওজন কমে যাওয়া, পেট ফুলে থাকা বা ব্যথা, চোখ ও চামড়ায় হলদেটে ভাব, বমিভাব বা বমি এবং প্রস্রাব গাঢ় হলুদ হওয়া। এ লক্ষণগুলো দেখা গেলে দ্রুত চিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়া উচিত।
অনেক কারণে বাংলাদেশে হেপাটাইটিস বি ও সি সংক্রমণের হার তুলনামূলক বেশি। অনেক মানুষ জানেই না যে তারা এই ভাইরাস বহন করছেন। তাই সচেতনতা ও স্ক্রিনিং এখন অত্যন্ত জরুরি। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্যমতে, দেশের প্রায় ৫ শতাংশ মানুষ হেপাটাইটিস বি পজিটিভ এবং প্রায় ১ শতাংশ হেপাটাইটিস সি আক্রান্ত। কিন্তু টিকাদান ও চিকিৎসার সুযোগ থাকা সত্ত্বেও এখনো অনেকে অন্ধকারে রয়েছেন।
যেভাবে ক্ষতি হয় লিভারের
লিভার আমাদের শরীরের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গগুলোর একটি। এটি রক্ত পরিশোধন করে, হজমে সাহায্য করে, ভিটামিন সংরক্ষণ করে এবং দেহকে টক্সিনমুক্ত রাখে। কিন্তু হেপাটাইটিস ভাইরাস যদি দীর্ঘদিন লিভারে থেকে যায়, তাহলে এটি ধীরে ধীরে লিভার কোষ ধ্বংস করতে থাকে।
এই ধ্বংস প্রক্রিয়ায় কয়েকটি ধাপ রয়েছে। প্রথমটি হলো— লিভার ফাইব্রোসিস। যখন ভাইরাস দীর্ঘদিন লিভারে প্রদাহ তৈরি করে, তখন লিভার কোষগুলো মরে যায় এবং তার জায়গায় আঁশ বা দাগ পড়ে। এ অবস্থাকেই বলে ফাইব্রোসিস। এটি প্রাথমিক পর্যায়, কিন্তু চিকিৎসা না হলে এটি আরও খারাপের দিকে যায়।
দ্বিতীয় ধাপটি হলো— সিরোসিস। এটি একটি মারাত্মক অবস্থা। যখন লিভারের আঁশগুলো জমে পুরো লিভারটাই শক্ত ও দাগযুক্ত হয়ে যায়, তখন একে বলে সিরোসিস। আর সিরোসিসের রোগীর জন্ডিস থেকে শুরু করে কোমাতেও চলে যেতে পারে। এ পর্যায়ে লিভার তার স্বাভাবিক কাজ করতে পারে না।
এটি ভইরাসজনিত রোগ
হেপাটাইটিস এ ও ই ছড়ায় দূষিত খাবার ও পানির মাধ্যমে। হেপাটাইটিস বি, সি ও ডি ছড়ায় রক্ত, অসুরক্ষিত যৌনসম্পর্ক, ইনফেক্টেড সিরিঞ্জ বা মা থেকে সন্তানের শরীরে।
তবে আশার কথা হচ্ছে— টিকা দিয়ে হেপাটাইটিস থেকে বাঁচা সম্ভব।
* হেপাটাইটিস বি’র টিকা তিনটি ডোজে পাওয়া যায়, যা প্রতিরোধে অত্যন্ত কার্যকর।
* সুরক্ষিত রক্ত গ্রহণ করুন।
* অযথা ইনজেকশন বা ট্যাটু নেওয়া থেকে বিরত থাকুন।
* পরিচ্ছন্ন খাবার ও বিশুদ্ধ পানি গ্রহণ করুন।
* নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা করুন, বিশেষ করে যদি আপনি ঝুঁকিপূর্ণ কোনো পেশায় থাকেন।