
সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক থেকে শুরু করে মাঠ পর্যায়ের সব কর্মকর্তার বেতন বাড়ছে। শিক্ষকদের বেতন দুই ধাপ বাড়িয়ে ১১তম গ্রেড করার জন্য প্রস্তাব দিয়েছে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর। সহকারী উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা থেকে বিভাগীয় উপপরিচালক পর্যন্ত সব কর্মকর্তার বেতন এক গ্রেড করে উন্নীত করার জন্য আগামী সপ্তাহে সুপারিশ করা হবে। প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
জানা গেছে, উচ্চ আদালতের নির্দেশে সম্প্রতি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকদের বেতন জাতীয় বেতন স্কেলের ১০ম গ্রেডে উন্নীত করা হয়। এ নিয়ে নতুন করে অসন্তোষ তৈরি হয়েছে সহকারী শিক্ষক ও সহকারী উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তাদের (এইউইও) মধ্যে। কারণ, বর্তমানে এইউইওদের বেতন স্কেলও ১০ম গ্রেডে। তদারকি কর্মকর্তার সঙ্গে প্রধান শিক্ষকের একই গ্রেডে অবস্থান প্রশাসনিক জটিলতা তৈরি করছে।
অন্যদিকে, সহকারী শিক্ষকরা রয়েছেন ১৩তম গ্রেডে। বেতন কাঠামোয় প্রধান শিক্ষক ও সহকারী শিক্ষকের মধ্যে তিন ধাপ পার্থক্য তৈরি হচ্ছে। টাকার অঙ্কে এ ব্যবধান দাঁড়াচ্ছে ইনক্রিমেন্টসহ প্রায় ১৫ হাজার।
এ ব্যবধানকে ‘বৈষম্য’ হিসেবে দেখছেন সহকারী শিক্ষকরা। এ অসন্তোষ দূর করতে সরকার বেতন গ্রেড উন্নীত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। অর্থ মন্ত্রণালয়ও এতে সায় দিয়েছে।
জানতে চাইলে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক আবু নূর মো. শামসুজ্জামান গতকাল বৃহস্পতিবার সমকালকে বলেন, প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষকদের পদনাম পরিবর্তন করে ‘শিক্ষক’ করা হয়েছে।
তাদের বেতন স্কেল ১১তম গ্রেডে উন্নীত করার জন্য সরকারের কাছে প্রস্তাব দিয়েছি। আর ইউএপিইও, উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা (ইউপিইও), জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা (ডিপিইও) এবং বিভাগীয় উপপরিচালকদের (ডিডি) বেতন স্কেল এক ধাপ উন্নীত করার প্রস্তাব মন্ত্রণালয়ে জমা দেওয়া হবে।
মহাপরিচালক জানান, প্রধান শিক্ষকদের বেতন ১০ম গ্রেডে উন্নীত করার পর অর্থ উপদেষ্টা, অর্থ সচিব, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা সচিব, তিনিসহ বসে বেতন বাড়ানোর যুক্তি তুলে ধরেন। এতে অর্থ মন্ত্রণালয় ইতিবাচক সায় দিয়েছে। নতুন পে-কমিশনের কাছে বেতন বাড়ানোর প্রস্তাব তুলে ধরা হচ্ছে।
বেতনবৈষম্যে ক্ষুব্ধ শিক্ষকরা
জানা গেছে, ২০১৩ সালে এক যৌথ আন্দোলনের মাধ্যমে প্রধান শিক্ষকরা দ্বিতীয় শ্রেণির মর্যাদা ও দুই ধাপ গ্রেড উন্নীত হন। সহকারী শিক্ষকরা তখন এক ধাপ উন্নীত হন। এর পর থেকে দুই পক্ষ গ্রেড বাড়ানোর দাবিতে আলাদা আন্দোলন শুরু করে।
২০১৯ সালে ৪৫ জন প্রধান শিক্ষক উচ্চ আদালতে রিট করেন। তারা ২০১৪ সাল থেকে গেজেটেড মর্যাদাসহ ১০ম গ্রেড দাবি করেন। আদালতে এটা মঞ্জুর হয়। একই সময় সহকারী শিক্ষক সমিতির সভাপতি মোহাম্মদ শামছুদ্দীন মাসুদের নেতৃত্বে সহকারী শিক্ষকরা ১১তম গ্রেড দাবিতে আরেকটি রিট করেন। এর শুনানি হয়নি। ফলে গ্রেড ব্যবধান তিন ধাপে পৌঁছেছে।
এই প্রসঙ্গে বাংলাদেশ প্রাথমিক বিদ্যালয় সহকারী শিক্ষক সমিতির সভাপতি মোহাম্মদ শামছুদ্দীন মাসুদ সমকালকে বলেন, প্রধান শিক্ষকরা ১০ম গ্রেড পাওয়ায় আমরা খুশি। এটি সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত। তবে সময় এসেছে বৈষম্য নিরসনের। এ জন্য সহকারী শিক্ষকদের ১১তম গ্রেড দিতে হবে।
তিনি আরও জানান, ১১তম গ্রেড, উচ্চতর গ্রেড সমস্যা এবং শতভাগ পদোন্নতির দাবিতে আগামী ৩০ আগস্ট ঢাকা কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে সহকারী শিক্ষকদের মহাসমাবেশ অনুষ্ঠিত হবে। সেখানে থেকে কঠোর কর্মসূচি ঘোষণার ইঙ্গিত দেন তিনি।
এ বিষয়ে সহকারী শিক্ষক সমাজের সাধারণ সম্পাদক মো. নুরে আলম সিদ্দিকী রবিউল বলেন, অন্তর্বর্তী সরকারের সময়ে গঠিত পরামর্শক কমিটি প্রস্তাব দিয়েছিল চাকরির শুরুতে ১২তম ও চার বছর পূর্তিতে ১১তম গ্রেড দেওয়ার। কিন্তু আমরা চাই শুরুতে ১১তম গ্রেড বাস্তবায়ন হোক।
কুষ্টিয়ার দৌলতপুর উপজেলার মথুরাপুর (পশ্চিম) সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষিকা আয়েশা ফেরদৌস বলেন, প্রধান শিক্ষকদের সঙ্গে একসময় আমাদের বেতন ব্যবধান ছিল ১০ টাকা। আর এখন হবে তিন ধাপে কয়েক হাজর টাকা। এই বৈষম্যের অবসান চাই।
লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলার মকরধ্বজ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক আনোয়ার হোসেন বলেন, বিগত সরকার আমাদের মূল্যায়ন করেনি। বর্তমান সরকারপ্রধান শিক্ষকদের ১০ম গ্রেড দিয়েছে। এই সরকারের আমলেই সহকারী শিক্ষকদের ১১তম গ্রেডের বাস্তবায়ন চাই।
কর্মকর্তারা হতাশ
এদিকে প্রধান শিক্ষকদের ১০ম গ্রেড কার্যকর হওয়ার পর একই গ্রেডে থাকা এইউইওরা ৯ম গ্রেড চাইছেন। তাদের মতে, প্রশাসনিক কাঠামোর ভারসাম্য বজায় রাখতে এইউইওদের ৯ম গ্রেডে উন্নীত করা জরুরি। তা না হলে প্রাথমিক শিক্ষার তদারকি ব্যবস্থা দুর্বল হয়ে যেতে পারে।
জানা গেছে, ইউএপিইও পদটি ১৯৭৮ সালে সৃষ্টি হয়। ১৯৯৪ সালে সংশোধিত নিয়োগবিধি অনুযায়ী পদটি ১০ম গ্রেডে উন্নীত করা হয়। সে সময়ের অধস্তন প্রধান শিক্ষক পদটি ১৭তম গ্রেডে এবং সহকারী শিক্ষক পদটি ১৮তম গ্রেডে ছিল। পরে প্রধান শিক্ষক পদটি কয়েক দফায় উন্নীত করায় ১০ম গ্রেড ও সহকারী শিক্ষক পদটি ১৩তম গ্রেডভুক্ত হয়। জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা ও পিটিআই সুপারিনটেনডেন্ট পদটি ৯ম গ্রেড থেকে ষষ্ঠ গ্রেডে এবং পিটিআই ইন্সট্রাক্টর পদটি ৩য় শ্রেণি থেকে ১ম শ্রেণি (৯ম গ্রেড) উন্নীতকরণ করা হয়েছে। অথচ ৩০ বছর ধরে ইউএপিইও পদটি ১০ম গ্রেডে রয়ে গেছে।
রাজধানীর ডেমরার সহকারী থানা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা ও বাংলাদেশ সহকারী উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা অ্যাসোসিয়েশনের কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি মুহাম্মদ মিলন মিয়া সমকালকে বলেন, ইউএপিইওরা প্রধান শিক্ষক ও সহকারী শিক্ষকের প্রশাসনিক ও একাডেমিক তত্ত্বাবধায়ক, মেন্টর, মনিটর, এসিআর ও ছুটি প্রদানকারী কর্মকর্তা। এ ক্ষেত্রে ইউএপিইও, প্রধান শিক্ষক একই গ্রেড হওয়ায় তাদের নিয়ন্ত্রণকারী কর্মকর্তা হিসেবে মাঠ পর্যায়ে দায়িত্ব পালনে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি ও চেইন অব কমান্ড ভেঙে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। তিনি বলেন, আমরা মূল কাজের পাশাপাশি সরকারের অর্পিত বিভিন্ন দায়িত্ব যেমন ভোটার রেজিস্ট্রেশন-সংক্রান্ত কাজে সহকারী রেজিস্ট্রেশন কর্মকর্তা, নির্বাচনে প্রিসাইডিং কর্মকর্তা, ভিজিএফ ও ভিজিডি-সংক্রান্ত কাজে তদারককারী কর্মকর্তা, সমাজসেবা, পরিবার পরিকল্পনা, স্থাস্থ্যসেবা ও নকলমুক্ত পরিবেশে পাবলিক পরীক্ষা অনুষ্ঠানে সহায়তাসহ নানা কাজ করে থাকি।
গুলশানের সহকারী থানা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা ও এই অ্যাসোসিয়েশনের সদস্য সচিব আল আমিন হাওলাদার বলেন, সরকারের নন-ক্যাডার ১ম শ্রেণির (৯ম গ্রেড) কর্মকর্তার জন্য নির্ধারিত শিক্ষাগত যোগ্যতা এবং ইউএপিইওদের নিয়োগবিধিতে উল্লেখিত শিক্ষাগত যোগ্যতা, নিয়োগ প্রক্রিয়া ও অন্যান্য শর্তাবলি একই। অথচ বেতন কেন দুই রকম হবে?
নতুন প্রস্তাবে কার বেতন কত হবে
সরকারের কাছে দেওয়া প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের প্রস্তাবে শিক্ষকদের বেতন ১৩তম গ্রেডের (১১ হাজার টাকা স্কেল) পরিবর্তে ১১তম গ্রেড (১২ হাজার ৫০০ টাকা স্কেল) করার কথা বলা হয়েছে। সারাদেশে ৬৬ হাজার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষক রয়েছেন সাড়ে তিন লাখের বেশি। ইউএপিইওদের ১০ম গ্রেডের (১৬ হাজার টাকা স্কেল) পরিবর্তে ৯ম গ্রেড (২২ হাজার টাকা স্কেল) দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। সারাদেশে এই পদের সংখ্যা দুই হাজার ৬০৭টি। ইউপিইওদের দেওয়া হবে ৯ম গ্রেডের (২২ হাজার টাকা স্কেল) পরিবর্তে ৮ম গ্রেড (২৩ হাজার টাকা স্কেল)। এ পদে কর্মরত ৫১৬ জন কর্মকর্তা। ডিপিইও আছেন ৬৮ জন, তাদের বেতন সপ্তম গ্রেডের (২৯ হাজার টাকা স্কেল) পরিবর্তে ষষ্ঠ গ্রেড (৩৫ হাজার ৫০০ টাকা স্কেল) দিতে সুপারিশ করা হচ্ছে। এর বাইরে বিভাগীয় উপপরিচালকদের পঞ্চম গ্রেডের (৪৩ হাজার টাকা স্কেল) পরিবর্তে চতুর্থ গ্রেডে (৫০ হাজার টাকার স্কেল) বেতন দেওয়ার সুপারিশ করা হচ্ছে।