
এবার দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি করতে সারা দেশে একযোগে পরিচালিত হচ্ছে ‘অপারেশন ডেভিল হান্ট’। এ অপারেশন যৌথভাবে পরিচালনা করছে সেনাবাহিনী, বিজিবি, র্যাব, পুলিশ ও পুলিশের গোয়েন্দা শাখা ডিবি।
গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর তথ্য অনুযায়ী বিভিন্ন প্রযুক্তি ব্যবহার করে অপারেশনে সন্ত্রাসীদের গ্রেপ্তার করা হবে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, পতিত আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসীরা দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি যেন নষ্ট করতে না পারে সেই জন্য এ অপারেশন পরিচালনা করা হচ্ছে।
ইংরেজি শব্দ ডেভিল অর্থ শয়তান আর হান্ট অর্থ শিকার। ফলে ডেভিল হান্ট-এর অর্থ দাঁড়ায় শয়তান শিকার করা। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ঘোষিত ডেভিল হান্ট বলতে দেশবিরোধী চক্র, সন্ত্রাসী ও দুষ্কৃতকারীদের বোঝানো হয়েছে।
এ বিষয়ে রোববার (৯ ফেব্রুয়ারি) সচিবালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব নাসিমুল গনি বলেন, প্রতিটি অপারেশনের একটি কোড নেম দেওয়া হয় অপারেশনকে ফোকাস করার জন্য।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সূত্রে জানা যায়, অপারেশন ডেভিল হান্টের প্রথম রাতে গাজীপুর জেলার পাঁচটি থানায় সাঁড়াশি অভিযান চালিয়ে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের অভিযোগে আওয়ামী লীগের ৪০ জন নেতাকর্মীকে আটক করা হয়েছে।
অপারেশন ডেভিল হান্টের লক্ষ্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সূত্রে জানা যায়, সম্প্রতি বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনে দেখা গেছে পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের সন্ত্রাসীরা দেশকে অকার্যকরের উদ্দেশে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নষ্ট করতে বিভিন্ন ষড়যন্ত্রমূলক কার্যক্রমে যুক্ত হয়েছে। তারা ষড়যন্ত্র করে দেশে একটি অস্থিতিশীল পরিবেশ সৃষ্টি করতে চাইছে। এর মধ্যে তাদের ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে দেশে কয়েকটি সন্ত্রাসী কার্যক্রম সংঘটিত হয়েছে। তাই দেশের সাধারণ মানুষকে নিরাপত্তা দিতে এ অপারেশন শুরু করা হয়েছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলোর যৌথভাবে পরিচালিত এ অপারেশনের প্রাথমিকভাবে বেশ কয়েকটি লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। সেই লক্ষ্য পূরণে সারা দেশে একযোগে অপারেশন পরিচালনা করা হচ্ছে।
সূত্র আরও জানা যায়, এ লক্ষ্যগুলোর মধ্যে প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে দেশে অস্থিতিশীল পরিবেশ সৃষ্টি কারা করছে এবং এ সন্ত্রাসীরা কীভাবে তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করছে সেগুলো শনাক্ত করা। শনাক্তের পর দেশব্যাপী অভিযান পরিচালনা করে সন্ত্রাসীদের দ্রুত গ্রেপ্তার করে আইনের আওতায় আনা। এ ছাড়া আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসীরা যেন দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নষ্ট করতে না পারে ও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্থিতিশীল এবং উন্নত করার লক্ষ্যে ‘অপারেশন ডেভিল হান্ট’ কাজ করবে। পাশাপাশি সন্ত্রাসী সংগঠনগুলোর কার্যক্রম নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করা হবে গোয়েন্দাদের মাধ্যমে। পরে গোয়েন্দারা তথ্য দিলে সন্ত্রাসী সংগঠনগুলোকে দমন করা হবে এবং তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
অপারেশন ডেভিল হান্ট কী ও যে কারণে শুরু স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সূত্রে জানা যায়, অপারেশন ডেভিল হান্ট একটি বিশেষ অভিযান। যা ৮ ফেব্রুয়ারি সারা দেশে একযোগে শুরু হয়েছে। গত ৭ ফেব্রুয়ারি গাজীপুরে ছাত্র ও সাধারণ জনগণের ওপর সন্ত্রাসী হামলা করে আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসীরা। এ হামলায় নেতৃত্ব দেয় ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত স্বৈরাচার শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগের কয়েকজন নেতাকর্মী। এ হামলায় বেশ কয়েকজন হতাহত হন এবং সার্বিক আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটে। ঘটনার পরপরই স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও অন্য নিরাপত্তা সংস্থার উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের বৈঠকে দেশের সামগ্রিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করার সিদ্ধান্ত হয়। এরই ধারাবাহিকতায় ৮ ফেব্রুয়ারি অপারেশন ডেভিল হান্ট নামক বিশেষ অভিযান শুরু হয়।
যারা পরিচালনা করবে অপারেশন ডেভিল হান্ট
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, সন্ত্রাস নির্মূলের এ অপারেশন পরিচালনা করবে বিভিন্ন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। বাহিনীগুলো গোয়েন্দা তথ্যের ওপর ভিত্তি করে সারা দেশে একযোগে যৌথভাবে অভিযান পরিচালনা করবে। বাহিনীগুলোর মধ্যে রয়েছে পুলিশ, র্যাব, সেনাবাহিনী, বিজিবি ও পুলিশের গোয়েন্দা শাখা ডিবি।
সরকার এ অভিযানকে জাতীয় নিরাপত্তার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে উল্লেখ করেছে। স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে সরকার সব ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণ করবে। সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
কতদিন পর্যন্ত চলবে অপারেশন ডেভিল হান্ট স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, অপারেশন ডেভিল হান্টের প্রাথমিক ধাপে বেশ কয়েকজন সন্ত্রাসী গ্রেপ্তার হয়েছে এবং বেশ কিছু অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার করা হয়েছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী জানিয়েছে, এ অভিযান দীর্ঘমেয়াদি হবে এবং সন্ত্রাসবাদের মূল উৎপত্তিস্থল চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
অপারেশন ডেভিল হান্ট নিয়ে যা বলছে বাহিনীগুলো আইনশৃঙ্খলা বাহিনীগুলোর সূত্রে জানা যায়, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে অপারেশন ডেভিল হান্ট ঘোষণার পর সবগুলো বাহিনী একসঙ্গে সমন্বিতভাবে সারা দেশে সাঁড়াশি অভিযান শুরু করেছে। সব গোয়েন্দা তথ্য একসঙ্গে বিচার-বিশ্লেষণ করে নির্দিষ্ট টার্গেটকে সামনে রেখে দেশের বিভিন্ন এলাকায় অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছে।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে অপারেশন ডেভিল হান্টের কার্যক্রম পরিচালনা করা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন পুলিশ সদরদপ্তরের এআইজি (মিডিয়া অ্যান্ড পিআর) ইনামুল হক সাগর। তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে ইতোমধ্যে এ অভিযানের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য বলা হয়েছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা অনুযায়ী পুলিশ এ অভিযানের কার্যক্রম পরিচালনা করছে। পুলিশের সব ইউনিক একযোগে সারা দেশে এ অভিযানে অংশগ্রহণ করেছে এবং কার্যক্রম পরিচালনা করছে।
অপারেশন ডেভিল হান্টে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী অন্য বাহিনীগুলোর সঙ্গে সমন্বিতভাবে কাজ করছে র্যাব। এ বিষয়ে র্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের উপ-পরিচালক (অতিরিক্ত দায়িত্বে পরিচালক) মেজর লুৎফুল হাদী ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমরা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী অন্য বাহিনীর সঙ্গে সমন্বয় করে যৌথভাবে অভিযানে কাজ করছি। আমরা গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহের পাশাপাশি সন্ত্রাসীদের গ্রেপ্তারের লক্ষ্যে যৌথভাবে কাজ করছি।
বিশেষ এ অপারেশনের বিষয়ে ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার (ডিবি) রেজাউল করিম মল্লিক ঢাকা পোস্টকে বলেন, ঢাকা শহরের মানুষজনকে নিরাপদ রাখতে আমরা প্রতিনিয়ত জোরালোভাবে অভিযান পরিচালনা করছি। অপারেশন ডেভিল হান্ট শুরু হয়েছে। আমাদের অভিযানও জোরালো হয়েছে। ঢাকা শহরের মানুষজন যেন নিরাপদে থাকতে পারে এবং স্থিতিশীল পরিবেশে থাকতে পারে, সেজন্য আমি যোগদান করার পর থেকে নিয়মিত সন্ত্রাসবিরোধী অভিযান পরিচালনা করছে ডিবি।
অপারেশন ডেভিল হান্টের বিষয়ে যা বলছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় রোববার (৯ ফেব্রুয়ারি) রাজধানীর ফার্মগেটের মৃত্তিকা সম্পদ ইনস্টিটিউটের নতুন মৃত্তিকা ভবন উদ্বোধনী অনুষ্ঠান শেষে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বলেন, ডেভিল যতদিন শেষ না হবে ততদিন পর্যন্ত অপারেশন ডেভিল হান্ট চলবে। যারা দেশকে অস্থিতিশীল করবে তাদের টার্গেট করে ডেভিল হান্ট অপারেশন চলবে। গাজীপুরে যারা ছাত্র-জনতার ওপর হামলার ঘটনা ঘটিয়েছে তাদের অনেককেই আইনের আওতায় আনা হয়েছে। তাড়াতাড়ি বাকিদেরও আনা হবে।
অন্যদিকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সম্মেলন কক্ষে অপারেশন ডেভিল হান্ট সম্পর্কে এক প্রেস ব্রিফিংয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব নাসিমুল গনি বলেন, এটা পুলিশি অ্যাকশন। পুলিশ কাজ করবে এবং সেনাবাহিনী এতে সহায়তা করবে। যেসব দেশে বিপ্লব হয়েছে সেখানে পরাজিত শক্তিকে কেউ রাখেনি। এ সরকার অতটা অমানবিক হতে পারেনি। আমরা পুলিশকে রিফর্ম করেছি। পুলিশের কেউ ভয়ে এবং চাপে পড়ে অন্যায় করেছে। কিছু অতি উৎসাহী ছিল তারা পালিয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে অ্যাকশন নেওয়া হচ্ছে। একটা বাহিনীর মনোবল ভেঙে গেছে। পুলিশে কিছু পরিবর্তন আনার চেষ্টা করছি। আমরা চাই পুলিশ কোমর সোজা করে দাঁড়াক। এজন্য তাদের অ্যাকটিভলি কাউন্সেলিং করছি।